রবিবার ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একজন নারী জাগরনের অগ্রদূত শাহাজাদী জাহানারা ওয়াজেদ

নাঈমা নাসরিন সুমি   |   বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট

একজন নারী জাগরনের অগ্রদূত শাহাজাদী জাহানারা ওয়াজেদ

সময়ের পরিক্রমায় দেখতে দেখতে সাতটি বছর পার হয়ে গেল আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ,নারী জাগরনের অগ্রদূত অধ্যক্ষ আলহাজ্জ্ব শাহাজাদী জাহানারা ওয়াজেদের চলে যাওয়ার। দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭২ সালের কথা- বিধ্বস্ত জনপদ,ধ্বংসপ্রায় লোকালয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা,শিক্ষা ব্যবস্থা সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা ছোট্ট থানা শহর শেরপুর।বিশেষকরে নারী শিক্ষার অনগ্রসরতা চরম। সেই অন্ধকার সময়ে মাত্র ১১জন মেয়েকে নিয়ে সামাজিক বাধাকে উপেক্ষা করে অসীম ধৈর্য্য ও ত্যাগ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শেরপুর মহিলা কলেজ যেটি এখন শেরপুর সরকারী মহিলা কলেজ।

শিশু আমি তখন সার্বক্ষনিক মার সঙ্গী। দেখতাম- যখনই, যেখানেই জানতে পারতেন কোথাও বাল্যবিবাহ হচ্ছে,অর্থের অভাবে কোন মেয়ে পড়তে পারছে না সেখানেই ছুটে যেতেন,সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।বাড়ি বাড়ি যেয়ে ডেকে এনে বিনা বেতনে নিজ দায়িত্বে ভর্তি করাতেন। নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে গেছেন। এই ত্যাগী নারী দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন বিবাহ হওয়ার পর সন্তান,পরিবার সামলে শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছেন।

আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা,পুরুষ শাসিত সামাজিক বাঁধাকে উপেক্ষা করে কলেজের বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে সেই শেরপুর থেকে নৌকা- বাস-ট্রেনে করে ডিজি অফিস,বোর্ড অফিসে দৌড়াদৌড়ী করেছেন।কলেজের উন্নয়নে একটু সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেছে।কখনো সারাদিন অপেক্ষা করেছেন একটি সই এর জন্য। আমি জানি দেখেছি সে কষ্ট। সে সময় সারাক্ষণ আমাকে সাথে রাখতেন, কচি হাতটি ধরে রাখতেন।বড় হয়ে একদিন জানতে চাইলে বললেন – অফিস পাড়ায় অসংখ্য পুরুষের তীর্যক চাহনি,বিরুপ মন্তব্য থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য আমাকে পাশে রাখতেন।কি কঠিন সময় পার করেছেন! তবুও হাল ছেড়ে দেন নি। নারী শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন।এই মহতী ত্যাগের পিছনে ছিলনা কোনো ব্যক্তি স্বার্থ অথবা কোন ক্ষমতার মোহ।

১৯৭৫ সালে কলেজটির আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার জন্য ময়মনসিংহ থেকে নৃত্যগুরু জগাদা ও তার টিম নিয়ে একমাস ব্যাপী মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘ নকশী কাথার মাঠ’ নৃত্যনাট্যটি টিকিটের বিনিময়ে মঞ্চস্থ করেন। এটি সুধী সমাজে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। ওই সময়ে এটি অত্যন্ত দুরহ ও সাহসিকতার কাজ ছিল। মেয়েদেরকে দিয়ে যে সুস্থ সংস্কৃতি চেতনার বিকাশ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন সম্ভব তা তিনি প্রমাণ করেছেন। মানুষ হিসাবে এবং শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী,মিষ্টভাষী,সংস্কৃতিমনা।তার বক্তৃতা ও ক্লাশ সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো ।পেশার প্রতি নিবেদিত এই শিক্ষক শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসাবে নির্বাচিত হন।

নারী শিক্ষার প্রসারতার লক্ষ্যে তিনি যে বীজ বপন করেছিলেন সেটির শেকড় যখন সবে শক্ত হতে শুরু করেছে,ডালপালা,কলি মাত্র ছড়াতে শুরু করেছে তখনই সরকারীকরনের সুবাদে সন্তানতুল্য এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে বদলী হতে হয়। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা অফিস, NEPE টিচার্স ট্রেনিং কলেজসহ বিভিন্ন সরকারী কলেজে অত্যন্ত সুনামের সাথে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ্যের দায়িত্ব পালন করেন। উনার মৃত্যুর ৩/৪বছর আগে হঠাত একদিন আমন্ত্রণ জানানো হয় কলেজটির পক্ষ থেকে। চার তলা বিশাল হোষ্টেলটির নামকরণ করা হয়েছে এই বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগীর নামে। সেই ফলক উন্মোচনের অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বক্তৃতায় অধ্যক্ষ মহোদয় বললেন ‘আমি যখন দেখি শত শত মেয়ে এই হোষ্টেলের গেট দিয়ে বের হচ্ছে তখন ভাবি এই নারীদের শিক্ষার পিছনে রয়েছে আরেক ত্যাগী নারীর অবদান, তিনি হচ্ছেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শাহাজাদী জাহানারা।এই হোষ্টেলের নাম -‘শাহাজাদী জাহানারা হল’ এই নামকরনের কোন বিকল্প নেই’। আমরা তার এই উদারতা এবং শেরপুর বাসীর সহযোগীতার জন্য কৃতজ্ঞ। এত কর্মযজ্ঞ, এত বর্ণাঢ্য জীবন, আলোকিত সংসার সবকিছু ছেড়ে সবার মতো তাকেও হার মানতে হয়েছে মৃত্যুর কাছে।

১৫ নভেম্বর২০১০।টিভিতে সম্প্রচার হচ্ছে পবিত্র হজ্জ্ব। লাখো লাখো মানুষের সাথে মোনাজাতে শরীক হওয়ার জন্য তিনিও ভাজ ভাঙা পরিষ্কার সাদা শাড়ী পড়ে নামাজ শেষে হুইল চেয়ারে বসে হাত তুলেছে…..
হঠাৎ বুকে প্রচন্ড ব্যাথা,কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হন। মাগো,এমৎন সুন্দর, পবিত্র ও সম্মানীয় মৃত্যু কজনের হতে পারে ?

মৃত্যুর পরও কিছু মানুষ বেচে থাকেন তার কীর্তির মাঝে। প্রয়াত অধ্যক্ষ আলহাজ্জ্ব শাহাজাদী জাহানারা নারী শিক্ষার যে আলো বহু বছর আগে ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন তার শিখা চিরন্তন হয়ে জ্বলবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। ভালো থেকো মা।। আল্লাহ তোমাকে বেহেস্ত নসীব করুক।

লেখক: সহকারী পরিচালক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ময়মনসিংহ।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১১:২৫ | বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com